বেকিং শুরুর গল্প

Butter cream cake with flowers

আমার জীবনের প্রথম কেক বানাতে শেখা আমার জেঠিমা’র কাছে। তিনি অবশ্য চুলায় কেক বানাতেন, বেসিক পাউন্ড কেক। চুলায় কড়াইয়ে বালি দিয়ে সেই বালি তেতে এলে টিফিন ক্যারিয়ার এর বাটিতে করে কেক এর মিশ্রণ ঢেলে দিয়ে এরপরে হতো সেই কেক। সেইটাও যে ঠিক-ঠাক পারতাম এমন না। তাছাড়া আমার কলেজ এর বন্ধূ পপি’র মা আমাদের জন্য কলেজে খুব মজার কেক বানিয়ে পাঠাতেন, সেটা খেয়ে খেয়ে খুব ইচ্ছে যে এরকম কিছু আমিও বানাবো। মাঝে মাঝে কলেজের পাশে ওয়েসিস বেকারী থেকে পেস্ট্রি আর হাবিজাবি কিনে খাই, সুমিজ হট কেক থেকেও এটাসেটা কিনি সুযোগ হলেই। বেকড জিনিস্ পুরাই স্বর্গীয় ব্যাপার তখন। আমি নিজে আসলে রান্না-বান্না বলতে ডিম ভাজি, আলু ভর্তা আর চুলার কেক অতদূরই পারি তখনো পর্যন্ত। বাবা পড়াশুনা নিয়ে ভীষণ সিরিয়াস, মেয়ে রান্নাঘরে ঢুকবে এ তো চিন্তার অতীত। বাবাকে লুকিয়ে, মাকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে তার জমানো টাকা দিয়ে একদিন স্যামসাং এর একটা microwave with convection ওভেন কিনে আনলাম, প্রথম আলো নকশার জমানো কাটিং থেকে রেসিপি নিয়ে এটা সেটা বানাতে ট্রাই করি, কিন্তু মায়ের বকুনী ও খাই, কারণ বেকিং এর জিনিশপত্রের সেই দাম! সেই ওভেন আবার আমার বাবার সামনে আনা হতো না। বাবা চাকুরীসূত্রে বেশিরভাগ সময় চিটাগং থাকতেন বলে টানা তিন বছর তিনি জানতেই পারেন নি যে আমরা একটা ওভেন কিনেছি।

এর মধ্যে আমার অনার্স শেষ হলো, চাকরী শুরু করলাম। জীবনে প্রথম প্রতিমাসে নিজের টাকা আসছে হাতে, শুরু হলো আমার বেকিং আর কুকিং এক্সপেরিমেন্ট একটু একটু করে। তাও সেটা ২০০৫ এর কথা। এর মধ্যে অনলাইনে কেক নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করি আর সুগারক্রাফট নিয়েও একটু একটু জানতে শুরু করেছি। কিন্তু আমি যেহেতু কোনদিন ও কোন ধরণের ক্রিয়েটিভ কাজ ই করি নি, এমনকি পেইন্টিং পর্যন্ত না, স্বপ্নেও ভাবিনি কোনদিন আমি নিজে এই ধরণের কোন কাজ করতে পারবো। ্তখন শুধু দেখার জন্যে দেখতাম।

২০০৭ এ আমি জয়েন করি একটা ফার্মে , সেখানে আমার বস নরোয়েজিয়ান আর তার স্ত্রী বাংলাদেশি, জানা আপা, তিনি আবার অসম্ভব ভালো বেক করেন। এদিকে অফিসের সবাই খুব মজার লোকজন। সবকিছু মিলিয়ে খুব ইন্সপায়ার্ড আমি, রোজ নতুন নতুন ডেজার্ট এক্সপেরিমেন্ট করে নিয়ে যাই অফিস এ। আমার কিন্তু অফিসে কাজের চাপ খুব ছিলো আর আমি একেবারেই ফাঁকিবাজ ছিলাম না, তবু রোজ বাসায় ফিরে দশটায় বেকিং শুরু করতাম, ১-২ টা পর্যন্ত ও বেজে যেতো মাঝে মাঝে। এভাবেই কেমন করে জানি আশে পাশে একটু আধটু পরিচিতি পেলাম রান্নাবিলাসী হিসেবে। আমার জীবনের প্রথম সুগারক্রাফট এর বই আমাকে ২০০৭ সালে আমার তৎকালীন সহকর্মী আর বর্তমানের বেস্টি মৌসুম এর দেওয়া। সেই বই এখনো বহাল তবিয়তে আছে আর আমি যে কি খুশিটা হয়েছিলাম সেটা পেয়ে। এর পরে আর তেমন কোন আলাদা প্রগ্রেস নাই, তবে ২০০৭-২০০৮ এর সামার এ অসলো গিয়ে প্রপার ইয়রোপীয়ান বেকিং এর সাথে পরিচয় হলো, আগ্রহ বাড়তে লাগলো। ইউরোপীয়ান কলিগরাও মাঝে মাঝে কেক এর প্রশংসা করতো, তখনো ভাবিনি বেকিং নিয়ে ক্যারিয়ার এর কথা।

২০০৯-২০১০ এ গেল্লাম যুক্তরাজ্য এ এম.বি.এ করতে। তখনো টুকটাক বেকিং করতে থাকতাম, কিন্তু খেতে যেমনি হোক সেসব কেক এর চেহারা ভয়ানক ছিলো। ২০০৮ থেকে অবশ্য আমি আমাদের বাসার সমস্ত জন্মদিনের কেক বানাই , চেহারা ভালো নিয়ে বাসায় কোন কমপ্লেইন ছিলো না। কারণ কেক সাজানোর সময় পাওয়া দূরের কথা ওভেন থেকে বের হওয়া মাত্র শেষ।

২০১২ এর ডিসেম্বর এর শেষ দিনে ছোট বোনের জন্মুদিনের কেক খেয়ে তার বন্ধুরা, আমার বোন সবাই বলতে লাগলো যেন বেকিং নিয়ে সিরিয়াসলি কিছু করি। ঝোঁকের বশে শুরু করে দিলাম আমি, আমার ছোট বোন আর রুমি এই তিন জন মিলে আমাদের বুটিক বেকারী- Punizz Kitchen। কি কি যে সব দিন গেছে আমাদের। কতো ভুল, কতো রাত জাগা, কতো মন খারাপ, কতো আনন্দের দিন, কতো ‘ইউরেকা’ মোমেন্ট! সেই সময়ে আমি আবার একটা বেসরকারী বিশ্ব বিদ্যালয়ে প্রভাষক এর কাজেও ছিলাম। পরে অবশ্য পুরোদস্তুর বেকার বনে গেছি। আমরা এখনো শিখেই যাচ্ছি আর আশা করি এই শেখার প্রসেস চলতেই থাকবে। এখনো অনেক অনেক কিছু শিখতে বাকি, করতে বাকি। সবাই দুয়া করবেন যেন আরো বহুদূর যেতে পারি। অনেকে আমাকে জিজ্ঞাসা করেন আমি কিভাবে সফল হলাম। আমি আসলে সফলতা বা বিফলতা নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাই না। যা করতে চাই সেইটা করে ঠিকঠাক বেঁচে থাকা যাচ্ছে এইটাই আমার কাছে সফলতা আসলে। আমি নিজেকে কারো সাথে তুলনা কখনো করতে চাইনা, নিজস্ব গতিতে যা যা ভালো লাগে শিখতে চেষ্টা করে যাচ্ছি, এইজন্যে আলাদা করে বাইরের কোন প্রেসার আমার উপরে কাজ করেনা, নিজে ভালো থাকলে সব ভালো। বেকিং আর কেক মেকিং আমার কাছে ভীষণভাবে ভালো থাকার উপায়। এই কাজকে প্রফেশান হিসাবে নেবার পরে নিশ্চিত হয়েছি যে আমার আর জীবনে অন্য আর কিছু হবার খায়েশ নেই। আমি বেকার ই হতে চেয়েছি, এখনো তাই চাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *